বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৬ পূর্বাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
পরপর তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন আজ। বহু আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এ দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণ। এরপর পঁচাত্তরে জাতির পিতার সপরিবারে নৃশংস হত্যাকান্ডের বেদনাদায়ক অধ্যায় পেরিয়ে আবার দেশ পরিচালনায় ফিরে আসা দলটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবে এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে।
আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ করোনা মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকটময় পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এসব পরিস্থিতির যেমন মোকাবিলা করতে হবে, তেমনি এক বছর পরই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিজয় ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ দলটির সামনে। তার আগে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সরকার হটানোর আন্দোলন সামাল দিতে হবে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে। এ দুটি চ্যালেঞ্জ উতরে গেলেই শুধু আওয়ামী লীগের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য সেটা পূরণ হতে পারে।
এ ছাড়া উন্নয়ন অগ্রযাত্রার নানা কর্মকান্ডসহ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি রোধ করতে না পারা অভিযোগ আছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারার সমালোচনাও আছে। এসব নিরসন করতে হবে দলটিকে। সে কারণে আওয়ামী লীগকে যোগ্য-বিচক্ষণ নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে একজন তুখোড় সহযোগী চান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ ক্ষেত্রে কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগের পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক, তা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যেও কৌতূহল রয়েছে। দলীয় আলোচনা বিবেচনায় নিলে দলের গুরুত্বপূর্ণ এ পদে নেতা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে মধ্যসারি ও তৃণমূল নেতৃত্বের মতে ফারাক আছে।
আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উন্মুক্ত অধিবেশনের পর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে হবে দ্বিতীয় অধিবেশন। এ অধিবেশনেই হবে নেতা নির্বাচন। কৃচ্ছ্রসাধনের বিষয়টি মাথায় নিয়ে এক দিনের সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সম্মেলনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
এবারের সম্মেলনে গঠনতন্ত্রে বড় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। শুধু সাংগঠনিক ইউনিটগুলো কমিটি গঠনে সম্মেলনের পর ৪৫ দিন সময় পাবে। এ ছাড়া কোনো পরিবর্তন নেই। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ‘উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয়’। তবে বিএনপির আন্দোলন ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নেতা নির্বাচনই গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করছেন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। তারা বলছেন, ক্ষমতায় থেকে এর আগের সম্মেলনগুলো একরকম চিন্তা করা হলেও এবার দক্ষ-যোগ্য ও কৌশলী নেতা নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক বিশ্বের রাজনীতি-অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকা নেতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ওই কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, একদিকে বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, অন্যদিকে কয়েকটি দেশ আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বসে আছে। তাদের সঙ্গে টেবিলের আলোচনায় পারদর্শী নেতা নির্বাচন করতে হবে। এসব সাধারণ সম্পাদকের ওপরই বর্তায় বেশি। তাই এ পদটি গুরুত্বপূর্ণ।
তবে আওয়ামী লীগের ওই কেন্দ্রীয় নেতাদের অধিকাংশই বলেন, সামনে নির্বাচন ও আন্দোলন মাথায় রেখে খুব বেশি পরিবর্তন আশা করছেন না তারা। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেই দাবি করেছেন, এবারের সম্মেলনে খুব বড় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। একই কথা বলেছেন দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান। তিনি বলেন, নির্বাচন-আন্দোলন ও গত দুই বছরের করোনা পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও এবারের সম্মেলনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, সভাপতি শেখ হাসিনার বাইরে বঙ্গবন্ধু পরিবারের আর কেউ আওয়ামী লীগের এবারের কমিটিতে আসবেন বলে মনে হয় না। সর্বশেষ জাতীয় কমিটির সভায় এ প্রসঙ্গে আমাদের নেতারা সুনির্দিষ্ট করে জানতে চান সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে। ওই বৈঠকে কয়েকজন নেতা দাবি করেন, জয় বা পুতুলকে নতুন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে রাজনীতির সুযোগ দেওয়া হোক। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তারা এখন পরিণত বয়সে। তাদের ভালো-মন্দ তারা বুঝতে পারে। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত তারাই নেবে।
আওয়ামী লীগ ও অন্য একটি সূত্র জানা গেছে, সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরকে প্রথমে রেখে কাজী জাফরউল্যাহ, ড. আবদুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফসহ কয়েকজনকে নিয়ে তালিকা করা হয়েছে। ৮১ সদস্যের বর্তমান কমিটির অন্তত দুই ডজন নেতা বাদ পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে সভাপতিমন্ডলীর সদস্য দুয়েকজন ছাড়া বাকিরা সম্পাদকমন্ডলী ও নির্বাহী সদস্য বলে জানা গেছে।
ওই সূত্র জানায়, অন্তত ১০ জন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেতে পারেন। তিন বছর মেয়াদি এ কমিটিতে সুযোগ পেয়েও যারা দুর্নাম কামিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া নারী নেতার সংখ্যা বাড়বে।
কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক সদস্য বলেন, সম্মেলনে তিন ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এক. কোনো পরিবর্তন আসবে না; দুই. সাধারণ সম্পাদকসহ বড় পরিবর্তন হবে ও তিন. নেতৃত্বের বড় একটি অংশ থাকবে না এবার।
তবে এবারের সম্মেলন নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা তেমন চোখে পড়েনি। দলটির দুই কার্যালয়ে আগের সম্মেলনে যেভাবে লোক সমাগম হতো এবার অনেক কম উপস্থিতি। কেন্দ্রীয় নেতারাও নিরুত্তাপ, তৃণমূলেও তাপ নেই। আওয়ামী লীগের সম্মেলনে মূল আকর্ষণ থাকে সাধারণ সম্পাদক পদটি নিয়ে। সভাপতি শেখ হাসিনার বাইরে নেতাকর্মীরা কাউকে ভাবতে না পারার কারণে শীর্ষ এ পদ নিয়ে আলোচনা থাকে না। সাধারণ সম্পাদক গতকাল শুক্রবার রাত পর্যন্ত ওবায়দুল কাদেরই থাকছেন এমন গুঞ্জনে এ পদটি নিয়েও আলোচনায় ভাটা পড়েছে। তবে কেউ কেউ বলছেন, শেখ হাসিনা চমক দিতে পারেন। তাই অন্যবারের মতো এবার সবাইকে ‘ক্লু-লেস’ অবস্থায় রেখেছেন দলীয় প্রধান। ঘোষণার আগপর্যন্ত এটি নিজের মধ্যেই রাখতে চান তিনি। অবশ্য মাসখানেক ধরে ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা শুনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা তাকেই এগিয়ে রাখছেন।
সম্পাদকম-লীর গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগে যেন এক ধরনের নেতৃত্বশূন্যতা চলছে। কারণ, ওবায়দুল কাদেরকে ছাড়া কেন্দ্রীয় আর কোনো নেতাকে সাধারণ সম্পাদকের যোগ্য মনে করছেন না অনেকেই। এটা দলের জন্য অশনিসংকেত দাবি করেন ওই দুই নেতা। তারা বলেন, শেখ হাসিনার বাইরে এই দলে আর কেউ অপরিহার্য নন। ফলে সাধারণ সম্পাদক পদে যোগ্যতা নেই এটা কেন আলোচনায় আসবে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বৈশি^ক রাজনীতিও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে প্রভাব রাখবে। তাই যিনি আছেন, সবদিক থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব হলে পরিবর্তন না হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সংগঠনটি সরকারের ভেতরে একাকার হয়ে গেছে এমন সমালোচনা প্রায় সর্বত্রই ছিল। দলে গণতন্ত্র নেই, বিশৃঙ্খলা, অনিয়মে চলছে এমন সমালোচনাও শুনতে হয়। তবে দলটির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগই নিয়মিত সম্মেলন করেছে। সাংগঠনিক জেলাগুলোতেও কমবেশি সম্মেলন হয়েছে। কেন্দ্র বা তৃণমূল সব পর্যায়ে কমবেশি নতুন নেতৃত্বও তুলে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে আওয়ামী লীগ।
পদ্মা সেতু ও নৌকার আদলে মঞ্চ
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের পাশে রমনা কালীমন্দিরমুখী করে সম্মেলন মঞ্চ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের বড় নিদর্শন পদ্মা সেতু ও দলীয় নির্বাচনী প্রতীক নৌকার আদলে ৮২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৪ ফুট প্রস্থের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চে চেয়ারের তিনটি সারি করা হয়েছে। প্রথম সারিতে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা বসবেন। পরের সারিতে সম্পাদকমণ্ডলী এবং সর্বশেষ সারিতে কার্যনির্বাহী সদস্যরা বসবেন। তবে ১২০ জনের আসন রাখা হয়েছে বলে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সাত হাজার কাউন্সিলর
বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কারণে সাদামাটাভাবেই করছে আওয়ামী লীগ। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সম্মেলনে ব্যাপকে শোডাউন করতে চায় দলটি। গঠনতন্ত্রে কাউন্সিলর সংখ্যা সীমাবদ্ধ থাকলেও ডেলিগেট ও আমন্ত্রিত অতিথির বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই। সম্মেলনে সাত হাজার কাউন্সিলর ভোট দিয়ে আগামী তিন বছরের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নির্ধারণ করবেন। এ ছাড়াও ডেলিগেট ও আমন্ত্রিত অতিথি মিলিয়ে ৫০ হাজারের বেশি উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি। সমসংখ্যক মানুষের ১ কোটি ২০ লাখ টাকা খাবারের ব্যয় ধরা হয়েছে।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দ্বিতীয় অধিবেশন
সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উদ্বোধনী অধিবেশন হলেও দ্বিতীয় অধিবেশন তথা সম্মেলনের মূল আকর্ষণ নেতৃত্ব নির্বাচন। বেলা ৩টা থেকে দ্বিতীয় অধিবেশন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে হবে। যেখানে উপস্থিত থাকবেন শুধু কাউন্সিলররা। সেখানে আর্থিক রিপোর্ট, গঠনতন্ত্র সংশোধনী প্রস্তাব, ঘোষণাপত্র সংশোধনীর প্রস্তাব ও পাস শেষে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সমাপনী বক্তব্য শেষে বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করা হবে।
পরে মূল আকর্ষণ নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুুনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি ভোট পরিচালনা করবেন। অন্য দুই সদস্য হলেন উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য মশিউর রহামন ও সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। প্রথমে সভাপতি, পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করবেন কাউন্সিলররা। গঠনতন্ত্র মতে, এ দুই পদে একাধিক প্রার্থী নাম প্রস্তাব না হলে তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হবেন। একাধিক হলে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে।
পরে দলীয় সভাপতি সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের নাম ঘোষণা করে কাউন্সিল অধিবেশনে পাসের জন্য প্রস্তাব করবেন। পরে দলটির সভাপতিমন্ডলীর বৈঠকে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের নাম চূড়ান্ত করার গঠনতান্ত্রিক বিধান রয়েছে।
ভয়েস/আআ